- আদর্শকে স্টল না দিয়ে প্রেস রিলিজ মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থানের দলিল - January 22, 2023
- বাচ্চারা কি গিনিপিগ নাকি? - January 19, 2023
- বিভাজনের রাজনীতি - July 9, 2020
গত কয়েকদিনে আয়মান সাদিকসহ কিছু সেলিব্রেটির ফেসবুক পোস্ট, তারপর বিভিন্ন পেইজ ঘুরে সেখানকার কমেন্টগুলো দেখলাম। ভয়াবহ বিদ্বেষ অনেক কমেন্টে। চেক করলে দেখা যায় এসব কমেন্টের অনেকগুলোই দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ফেইক একাউন্ট থেকে। যখন কোনো ফেইক একাউন্ট থেকে পরিকল্পিতভাবে কাওকে হ্যারেস করার চেষ্টা করা হয় তার একটা লক্ষণ হচ্ছে ওই ফেইক একাউন্ট থেকে বারবার কমেন্ট করা হয়। এছাড়া স্বপ্নের ঢাবি গ্রুপে যেসব পোস্ট করা হয় সেখানে কমেন্টে ভয়াবহ বাজে কথা বলে যে একাউন্ট গুলো সেখানে একটা অংশ হয় ছাত্রলীগের একাউন্ট(profile এ works at বাংলাদেশ ছাত্রলীগ লেখা)। যেমন: ঈদের দিন বামদের ইসলামোফোব বলে যেসব পোস্ট করা হচ্ছিল, সেখানে বামদের গালিগালাজ করে যেসব কমেন্টকারী অনেক একাউন্ট ঘেঁটে দেখা যায় works at বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অমুক হল, তমুক হল লেখা। ওই সময়ের পরে স্বপ্নের ঢাবি গ্রুপে বামপন্থীদের(রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে যারা ছাত্রলীগের নাম নেয়) সবাইকে নাস্তিক ও ইসলামোফোব প্রমাণ করার প্রচুর পোস্ট পাওয়া যায়, যেখানে কমেন্টকারীদের ব্যাপক অংশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন হলের কর্মীরা। ২৫ মে ওই ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন গ্রুপে মূলত ‘বাম’, ‘প্রগতিশীল’, ‘সেক্যুলার’ এই শব্দত্রয়কে গালিহিসেবে(টিটকারি হিসেবে) ব্যবহারের প্রবণতা ব্যাপক বেড়ে গেল। আরেকটা ছিল; ‘এলিট’ মনে হয়!!! এটাকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে বিপরীত পক্ষ নিজেদের প্রগতিশীল পরিচয়কে সামনে আনার ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আবার কেও কেও সে যে বাম না সেটা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক উচ্চমন্যতার কারণে নিজেদের পয়েন্ট বোঝাতে গিয়ে একটা অন্য বিভেদের সৃষ্টি করছে(political elitism, যেটা আমার মনে একটা দেশকে রাজধানী কেন্দ্রীক ভাবে পরিচালনা করার ফলাফল কারণ দেশের ঢাকা কেন্দ্রীকতার কারণে রাজধানীর জীবনযাপনের সাথে গোটা দেশের জীবন যাপন ও মানসিকতার একটা বড় পার্থক্য তৈরি হয়)। সমকামিতা সংক্রান্ত পোস্ট গুলো থেকে তাদের আরো সরাসরি ধর্মবিরুদ্ধ বা নাস্তিক প্রমাণ করার চেষ্টা জোরদার হয়েছে। এবং এই সকল পোস্টে কমেন্টকারীর একটা অংশ হয় লীগের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা। সমকামিতা বিষয়ে যেসব পোস্ট করা হচ্ছে সেসবের কমেন্টে নাস্তিক মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ফেলার চেষ্টা করা ব্যাপক একাউন্ট হয় ফেইক একাউন্ট।
আমার এই কথাগুলো বলার কারণ এই জায়গায় ব্যাপক অংশের আলাপ আলোচনা থেকে বাম বনাম ইসলামিস্ট এ ধরনের একটা বিভক্তি তৈরী চূড়ান্ত চেষ্টা করা হচ্ছে এবং পুরো চেষ্টাটা খেয়াল করলে দেখা যায় যারা ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যখন বামদের সর্বসম্মতভাবে নাস্তিক প্রমাণ করে সাইডেড করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যেখানে পালে হাওয়া লাগায় ছাত্রলীগের একটা অংশ আর ফেইক একাউন্ট।
আরো খেয়াল করলাম, বেগম রোকেয়াকে নাস্তিক প্রমাণ করে, সফট তসলিমা নাসরিন তকমা দেয়া হলো। একজন মানুষ ইতিহাস না পড়ে শুধু বেগম রোকেয়ার কোনো একটা লাইন পরে “তিনি নাস্তিক, তার আর তসলিমা নাসরিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই, এই মহিলা খ্রীষ্টান মিশনারিদের এজেন্ট” ফতোয়া জারি করে দিল। মানুষ তার সময়ের সন্তান। বেগম রোকেয়ার সময়কার বিস্তারিত ইতিহাস না পরে যা ইচ্ছা তা বলে দিয়ে তাকে নারীবাদী নাস্তিক প্রমাণ করে খারিজ করে দেয়ার প্রচন্ড প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন, কোনোভাবে একটা মানুষকে নাস্তিক প্রমাণ করে দাও। ব্যাস!! সে জীবনে আর যাই করুক না কেন তার আর কোনো মানে নাই। মহানবী (সঃ) মারা যাওয়ার পরবর্তীতে ইসলামী খেলাফতের যুগে যেসকল মুসলিম মনীষীর কথা আমরা জানি তাদের বিজ্ঞান ও দর্শনের সূচনা হয়েছে গ্রিক আর ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও দর্শনের থেকে। আরব বিজ্ঞান স্বতন্ত্রভাবে উদ্ভূত হয় নাই। বরং গ্রিক আর ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে। গ্রিক আর ভারতবর্ষের বিজ্ঞানীরা তো মূর্তিপূজা করত। তাদের বিজ্ঞান আর দর্শনকে গ্রহণ করা কি ইসলামবিরুদ্ধ? এইভাবে মেরুকরণ করাতো কখনোই কোনো ভালো সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। শুধুমাত্র কিছু গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক হতে পারে।
এই মেরুকরণের চেষ্টাকেই বিভাজনের রাজনীতি বলে।এই পুরো ঘটনা যাচ্ছে মূলত সিস্টেমের পকেটে। আওয়ামী লীগ এখনো জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেনি কেন তার জবাব কি কেও দিতে পারবে? জামায়াতকে একটা জুজুর মতো দেখিয়ে ২০১৩ থেকে আওয়ামী লীগ নিজেকে মন্দের ভালো হিসেবে দেখিয়ে আসছে, ‘দেখ আমরা গেলে কিন্তু ওরা চলে আসবে’। আজকে করোনার সময়ে প্রত্যেকটা সেক্টরে ভয়াবহ ফাটল তৈরী হয়েছে। ঢাকা শহরের মানুষ বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে কারণ বাসা ভাড়া দেয়ার মতো টাকা নাই। ছাত্রদের জিনিসপত্র সমেত মেস থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে মেসভাড়া পরিশোধ করেনি তাই। ব্রাকের সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে দরিদ্র হয়েছে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হচ্ছে গণহারে। রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টা পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে লোকসান দেখিয়ে, ৫০,০০০ এর মতো পাটকল শ্রমিক পথে বসে গেছে। মধ্যবিত্তদের চলা মুশকিল হয়ে গেছে। একে তো বেতন ৬০%, তার উপর বাড়িভাড়া পুরা পরিশোধ করতে হচ্ছে। বাড়িওয়ালাদের অনেকের ব্যাংকে লোনের কিস্তি পরিশোধ করা বাকি অথচ বাড়িভাড়া পাচ্ছেন না ঠিকমতো কারণ ভাড়াটিয়ার নিজেরই চলার অবস্থা নাই। অথচ খেয়াল করেন সরকারের এটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনাই নাই। এই বাড়িভাড়া সমস্যা নিয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি, তার সাথে যোগ হয়েছে যখন তখন ছাঁটাই। একদিন অফিসে না গেলে পরেরদিন শুনেন চাকরি চলে গেছে। ছাত্ররা অনলাইন ক্লাস যে করবে ভালো মোবাইল নাই, ডেটা কানেকশন আসেনা ঠিকমতো, তারপর মরার উপর খারাপ ঘাঁ মোবাইল কলরেটের উপর ৩৩% কর। বরাদ্দ কোথায় রাখা হয়েছে শুনবেন?
শুনুন-
রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র- ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা
পদ্মাসেতু- ৫ হাজার কোটি টাকা
মেট্রোরেল প্রকল্প- ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা
মহেশখালির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র- ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা
প্রতিরক্ষা খাত- ৩৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা
এছাড়া কোভিডকালীন ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্টে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ২৬৭ জন(প্রতি মাস গড়ে ৮২ জন)। একজন ক্লাস ৯ এর বাচ্চাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সরকারের সমালোচনা করার কারণে। তাকে সরকারের সমালোচনা করার কারণে শিশু শোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। কিন্তু এই সময়ে মানুষের জন্য সেই জামায়াতকে যেমন মূলা হিসেবে দেখাত( ইদানীং যেটা আর কাজে দিচ্ছে না) সেই ইসলামিস্ট ভার্সাস প্রগতিশীল বিনোদনের ব্যবস্থা করে দিয়ে নিজের লুটপাটের সব পথ পরিষ্কার করে রাখছে। ওই জুজুর পালে হাওয়া দেয়ার জন্য নিজেদের ফেইক একাউন্ট আর দলীয়দাসদেরও নিয়োগ করে রাখা হয়েছে। আর স্রোত যখন এদিকে জনগণ তো সেই স্রোতেই গা ভাসাবেই।
একটা তথ্য বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছে। তোষা পাট সহ বিভিন্ন বিশ্ব বিখ্যাত পাটের জন্মস্থান হলো বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে পাটশিল্প ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শক্তি । অথচ হঠাৎ করে স্বাধীনতার পর এই শিল্প অলাভজনক খাতে পরিণত হতে থাকে। এখনো দেখা যায়, পাটশিল্প থেকে প্রতি বছর আয় হয় মাত্র ৫০০০ কোটি টাকার মতো, আর ভারত থেকে পাটের বীজ আমদানি করার জন্য প্রতিবছর খরচ হয় ৩০০০ কোটি টাকা। কি হাস্যকর, যে পাটের অরিজিন হলো বাংলাদেশ, সে পাটের হাইব্রিড বীজ কিনা ভারত থেকে আনতে হয়?! অথচ প্রথম পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছিল বাংলাদেশের একটা দল। মাত্র কয়েকশ কোটি টাকা ইনভেস্ট করলে পাট গবেষণায় অনেক সফলতা আনা সম্ভব। শুধুমাত্র পাটকে ব্যবহার করে বিশ্ববাজারে নিজেদের প্রধান্য তৈরী করার পর্যাপ্ত সুযোগ এখনো বাংলাদেশের আছে। তা না করে এই শিল্পকে পথে বসানোর সব ধরনের পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছে। অথচ, এসব ছেড়ে মানুষ দেখলেই প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি সমকামিতা সমর্থন করেন?’। আর যদি কেও মুখ ফুটে বলে যে সে মনে করে সমাজে সমকামিদের অধিকার দেয়া প্রয়োজন তখন তাকে নাস্তিক, মুরতাদ, খ্রিস্টান মিশনারিদের এজেন্ট ঘোষণা দিয়ে তার সকল মতকে এক সাইড করে দেয়ার সকল ব্যবস্থা করে ফেলা হয়।
পয়েন্টটা কতটুকু বোঝাতে পেরেছি জানিনা। মানুষ ভাবনাকে সবসময় কথায় পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে না। মাথায় দেখা যাচ্ছে অনেকভাবে ভাবছি কিন্তু ভাবনার জটিলতার কারণে প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে।
ধন্যবাদ।
উমামা ফাতেমা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
1,033 total views, 1 views today